গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস মায়ের শরীরের পরিবর্তন ও যত্ন



 গর্ভাবস্থা প্রতিটি নারীর জীবনে এক নতুন অধ্যায়। এই সময়টাতে একজন মায়ের শরীরে আসে নানা পরিবর্তন এবং দেখা দেয় কিছু নতুন অভিজ্ঞতা। গর্ভধারণের প্রথম তিন মাস (প্রথম ত্রৈমাসিক) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সময়ে ভ্রূণের মূল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গঠিত হতে শুরু করে। তাই এই সময় মায়ের বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।

প্রথম ত্রৈমাসিকে মায়ের শরীরে যেসব পরিবর্তন দেখা যায় তার মধ্যে অন্যতম হল হরমোনের পরিবর্তন। গর্ভধারণের পর থেকেই শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মাত্রা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। এই হরমোনের পরিবর্তনের কারণে অনেক গর্ভবতী নারী সকালের দুর্বলতা (Morning Sickness) অনুভব করেন। বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, খাবারে অরুচি বা কোনো বিশেষ খাবারের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখা দিতে পারে। যদিও এর নাম ‘সকালের দুর্বলতা’, তবে এটি দিনের যেকোনো সময় হতে পারে। এই সময়ে ক্লান্তি এবং ঘুমের অভাবও খুব সাধারণ একটি সমস্যা। হরমোনের প্রভাবে স্তন কিছুটা ভারী ও স্পর্শকাতর হয়ে উঠতে পারে। ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ পাওয়াও এই সময়ের একটি সাধারণ লক্ষণ।

শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি মানসিক পরিবর্তনও এই সময় অনুভূত হতে পারে। গর্ভবতী মায়েরা Emotional instability বা মানসিক অস্থিরতা অনুভব করতে পারেন। সামান্য কারণে মন খারাপ লাগা, আবার পরক্ষণেই ভালো লাগা—এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। গর্ভধারণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর অনেক নারী আনন্দ ও উদ্বেগের মিশ্র অনুভূতিতে ভুগতে পারেন।

এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মায়ের সঠিক যত্ন নেওয়া অপরিহার্য। কিছু নিয়ম মেনে চললে প্রথম ত্রৈমাসিকের অনেক discomfort বা অস্বস্তি কমানো সম্ভব।

খাদ্য ও পুষ্টি: প্রথম ত্রৈমাসিকে মায়ের খাবারের প্রতি বিশেষ ध्यान দেওয়া উচিত। এই সময় ভ্রূণের সঠিক বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা জরুরি।

  • ফলিক অ্যাসিড: নিউরাল টিউব ডিফেক্ট (Neural Tube Defects) নামক জন্মগত ত্রুটি এড়াতে গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার অথবা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। সবুজ শাকসবজি, মটরশুঁটি, বাদাম এবং ফলিক অ্যাসিড ফর্টিফাইড খাবার তালিকায় যোগ করুন।
  • প্রোটিন: ভ্রূণের কোষ গঠন এবং মায়ের শরীরের পরিবর্তনের জন্য প্রোটিন অপরিহার্য। ডিম, মাছ, মাংস, ডাল এবং দুগ্ধজাত খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণ করুন।
  • কার্বোহাইড্রেট: জটিল কার্বোহাইড্রেট যেমন আটা, ব্রাউন রাইস, ওটস—এগুলো শক্তি সরবরাহ করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
  • ভিটামিন ও খনিজ: ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম এবং আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা মায়ের ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
  • পর্যাপ্ত জল পান: ডিহাইড্রেশন বা শরীরে জলের অভাব এড়াতে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করা উচিত।

সকালের দুর্বলতা কমাতে অল্প অল্প করে বার বার খাবার গ্রহণ করা, তৈলাক্ত ও মশলাদার খাবার এড়িয়ে চলা এবং আদা চা বা লেবুর গন্ধ নেওয়া উপকার দিতে পারে।

বিশ্রাম ও ঘুম: প্রথম ত্রৈমাসিকে ক্লান্তি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুম (অন্তত ৮ ঘণ্টা) এবং দিনের বেলায় বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। অতিরিক্ত পরিশ্রম এড়িয়ে চলুন এবং নিজের শরীরের প্রতি মনোযোগ দিন।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: গর্ভধারণ নিশ্চিত হওয়ার পরই একজন ভালো গাইনিকোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো এবং ভিটামিন ও অন্যান্য সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা জরুরি। এই সময় ডাক্তার মায়ের স্বাস্থ্য এবং ভ্রূণের সঠিক বিকাশ সম্পর্কে নিশ্চিত হন।

কিছু সতর্কতা: প্রথম ত্রৈমাসিকে কিছু বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

  • ধূমপান ও মদ্যপান সম্পূর্ণভাবে বর্জন করুন।
  • ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ গ্রহণ করবেন না।
  • এক্স-রে বা তেজস্ক্রিয় বিকিরণ এড়িয়ে চলুন।
  • ভারী জিনিস তোলা বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা থেকে বিরত থাকুন।
  • কাঁচা বা ভালোভাবে রান্না না করা মাংস ও ডিম পরিহার করুন, কারণ এতে ব্যাকটেরিয়া থাকার ঝুঁকি থাকে।

প্রথম তিন মাস গর্ভবতী মায়ের জন্য একটি সংবেদনশীল সময়। নিজের শরীরের যত্ন নেওয়া, সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা এবং ডাক্তারের নিয়মিত পরামর্শ মেনে চলা মা ও শিশুর সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় ধৈর্য ধরুন এবং ইতিবাচক থাকুন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন