গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় তিন মাস মায়ের খাদ্য ও পুষ্টি

 


গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক (চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ মাস) সাধারণত প্রথম ত্রৈমাসিকের তুলনায় কিছুটা স্বস্তিদায়ক হয়। সকালের দুর্বলতা কমে আসে এবং মায়ের শরীরে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। তবে এই সময় ভ্রূণের দ্রুত বিকাশ হতে থাকে, তাই মায়ের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। এই সময় সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা মায়ের স্বাস্থ্য এবং শিশুর সুস্থ বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।

দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ভ্রূণের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আরও পরিপক্ক হতে শুরু করে এবং তার আকার দ্রুত বাড়তে থাকে। মায়ের শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় এবং ওজন বাড়তে শুরু করে। এই পরিবর্তনগুলোর জন্য মায়ের শরীরে অতিরিক্ত ক্যালোরি, প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের প্রয়োজন হয়।

এই সময়ে মায়ের খাদ্যতালিকায় কিছু বিশেষ পুষ্টি উপাদান যোগ করা জরুরি:

  • ক্যালোরি: দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে প্রতিদিন প্রায় ৩০০-৩৫০ ক্যালোরি অতিরিক্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। তবে এই অতিরিক্ত ক্যালোরি যেন পুষ্টিকর খাবার থেকে আসে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ফাস্ট ফুড বা অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার পরিহার করা উচিত।
  • প্রোটিন: ভ্রূণের কোষ গঠন, টিস্যু তৈরি এবং মায়ের শরীরের পরিবর্তনের জন্য প্রোটিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন অন্তত ৭০-৮০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করা উচিত। ডিম, মাছ, মাংস, ডাল, সয়াবিন এবং দুগ্ধজাত খাবার প্রোটিনের ভালো উৎস।
  • আয়রন: গর্ভবতী মায়ের শরীরে রক্তের পরিমাণ বাড়ে, তাই আয়রনের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। আয়রনের অভাবে রক্তশূন্যতা (Anemia) হতে পারে, যা মা ও শিশুর জন্য ক্ষতিকর। লাল মাংস, কলিজা, সবুজ শাকসবজি, খেজুর এবং আয়রন ফর্টিফাইড খাবার খাদ্যতালিকায় যোগ করুন। আয়রন শোষণে ভিটামিন সি সহায়ক, তাই ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার (যেমন লেবু, আমলকী, পেয়ারা) গ্রহণ করুন।
  • ক্যালসিয়াম: শিশুর হাড় ও দাঁত গঠনের জন্য ক্যালসিয়াম অপরিহার্য। মায়ের শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব হলে শিশুর বিকাশে সমস্যা হতে পারে এবং মায়ের হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। দুধ, দই, পনির, সবুজ শাকসবজি এবং ক্যালসিয়াম ফর্টিফাইড খাবার গ্রহণ করুন।
  • ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড: শিশুর মস্তিষ্ক ও চোখের বিকাশে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্যামন, টুনা, ম্যাকারেল এবং ফ্ল্যাক্সসিডের মতো খাবার ওমেগা-৩ এর ভালো উৎস। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্টও গ্রহণ করা যেতে পারে।
  • ফাইবার: গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য একটি সাধারণ সমস্যা। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার যেমন ফল, সবজি, শস্য এবং মটরশুঁটি গ্রহণ করলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
  • ভিটামিন ও খনিজ: অন্যান্য ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ যেমন ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, জিঙ্ক এবং ম্যাগনেসিয়ামও মায়ের ও শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য প্রয়োজন। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মাল্টিভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে।

খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মেনে চলা উচিত:

  • ছোট ও ঘন ঘন খাবার গ্রহণ: একবারে বেশি খাবার না খেয়ে অল্প পরিমাণে খাবার কয়েকবার করে খান। এতে হজম ভালো হয় এবং বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা কমে।
  • পর্যাপ্ত জল পান: প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস জল পান করা জরুরি। জল শরীরকে ডিহাইড্রেশন থেকে রক্ষা করে এবং হজমক্ষমতাকে সঠিক রাখে।
  • প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার: প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্ট ফুড এবং অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার পরিহার করুন। এগুলোতে পুষ্টির পরিমাণ কম থাকে এবং অস্বাস্থ্যকর উপাদান বেশি থাকে।
  • ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল বর্জন: চা, কফি এবং কোমল পানীয়ের মতো ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় এবং অ্যালকোহল সম্পূর্ণরূপে বর্জন করুন। এগুলো শিশুর বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
  • ধূমপান পরিহার: ধূমপান মা ও শিশুর উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।

দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে মায়ের খাবারের পাশাপাশি কিছু সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত:

  • নিয়মিত ব্যায়াম: ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হালকা ব্যায়াম যেমন হাঁটা, যোগা বা সাঁতার করা যেতে পারে। এটি শরীরকে সচল রাখে এবং প্রসবের জন্য প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করে।
  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম: প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো জরুরি। দিনের বেলাতেও বিশ্রাম নেওয়া উচিত।
  • মানসিক স্বাস্থ্য: মানসিক চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন। পছন্দের কাজ করুন, গান শুনুন বা বন্ধুদের সাথে সময় কাটান। প্রয়োজনে মনোবিদের পরামর্শ নিন।
  • নিয়মিত চেকআপ: ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো জরুরি।

দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক মায়ের ও শিশুর সুস্থ ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এই সময়ের প্রধান চাবিকাঠি। মায়ের শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চললে একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক গর্ভাবস্থা আশা করা যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন