আপনার শরীর কি বন্ধুকে শত্রু ভাবে? জানুন এলার্জির গোপন রহস্য

 



এলার্জি: যখন আপনার শরীর ভুল করে বন্ধুকে শত্রু ভাবে

আমাদের চারপাশে এমন অনেক জিনিস রয়েছে যা সাধারণত আমাদের কোনো ক্ষতি করে না। কিন্তু কিছু মানুষের শরীর এই নিরীহ জিনিসগুলোর প্রতি অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই প্রতিক্রিয়াই হলো এলার্জি। হাঁচি, কাশি, ত্বকে চুলকানি বা র‍্যাশ, শ্বাসকষ্ট—এগুলো সবই এলার্জির পরিচিত লক্ষণ। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন, কেন আমাদের শরীর এমন ভুল করে এবং কেন কিছু লোকের এলার্জি হয়, অন্যদের নয়?

এলার্জি একটি বহুমাত্রিক এবং জটিল প্রক্রিয়া। এটি আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি ত্রুটিপূর্ণ প্রতিক্রিয়া, যেখানে শরীর কোনো ক্ষতিকর নয় এমন পদার্থকে (এলার্জেন) ক্ষতিকর জীবাণু ভেবে ভুল করে এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ শরীরে বিভিন্ন ধরণের উপসর্গ দেখা দেয়।

এই ব্লগ পোস্টে আমরা এলার্জির মূল কারণ, কীভাবে এটি শরীরে কাজ করে, বিভিন্ন প্রকার এলার্জেন এবং কেন কিছু ব্যক্তি অন্যদের তুলনায় এলার্জির ঝুঁকিতে বেশি থাকে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

এলার্জির মূল প্রক্রিয়া: যখন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়

আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (immune system) সর্বদা ক্ষতিকর জীবাণু, ভাইরাস এবং অন্যান্য বহিরাগত আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমাদের সুস্থ রাখে। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মূল কাজ হলো ক্ষতিকর এবং নিরীহ পদার্থের মধ্যে পার্থক্য করা। কিন্তু এলার্জিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে, এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিছু নিরীহ পদার্থকে ভুল করে ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করে। এই নিরীহ পদার্থগুলোই হলো এলার্জেন।

যখন কোনো এলার্জিযুক্ত ব্যক্তি প্রথমবার কোনো এলার্জেনের সংস্পর্শে আসে, তখন তার শরীর এটিকে একটি হুমকি হিসেবে শনাক্ত করে এবং ইমিউনোগ্লোবুলিন ই (IgE) নামক এক ধরণের অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এই IgE অ্যান্টিবডিগুলো শরীরের মাস্ট কোষের (mast cells) সাথে যুক্ত থাকে, যা ত্বক, নাক, গলা এবং অন্ত্রের আস্তরণে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান।

দ্বিতীয়বার যখন ঐ ব্যক্তি একই এলার্জেনের সংস্পর্শে আসে, তখন এই এলার্জেন সরাসরি মাস্ট কোষের সাথে যুক্ত IgE অ্যান্টিবডিগুলোর সাথে আবদ্ধ হয়। এই বন্ধনের ফলে মাস্ট কোষগুলো হিস্টামিন (histamine) এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে। এই রাসায়নিক পদার্থগুলোই এলার্জির বিভিন্ন লক্ষণ সৃষ্টি করে, যেমন—

  • হিস্টামিন: রক্তনালীগুলোকে প্রসারিত করে এবং তাদের দেয়ালকে আরও প্রবেশযোগ্য করে তোলে, যার ফলে ত্বক লালচে হয়, চুলকানি হয় এবং ফোলাভাব দেখা যায়। এটি নাক এবং গলায় শ্লেষ্মা উৎপাদনও বাড়িয়ে তোলে, ফলে হাঁচি এবং নাক বন্ধের মতো সমস্যা হয়।

অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থগুলোও প্রদাহ সৃষ্টিতে এবং এলার্জির তীব্রতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

বিভিন্ন প্রকার এলার্জেন: শত্রুরূপী বন্ধুরা

আমাদের চারপাশে অসংখ্য এলার্জেন বিদ্যমান। ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন পদার্থের প্রতি এলার্জি থাকতে পারে। কিছু সাধারণ এলার্জেন হলো:

  • বায়ুবাহিত এলার্জেন:

    • পরাগ রেণু (গাছপালা, ঘাস এবং আগাছার)।
    • ধুলো এবং ধুলোর মাইট (dust mites)।
    • প্রাণীর লোম এবং খুশকি (যেমন বিড়াল, কুকুর)।
    • ছত্রাক বা মোল্ড (mold spores)।
  • খাবার:

    • বাদাম (যেমন চিনাবাদাম, কাঠবাদাম)।
    • দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য।
    • ডিম।
    • সয়াবিন।
    • গম।
    • মাছ এবং শেলফিশ।
  • পোকা এবং কীটপতঙ্গ:

    • মৌমাছি ও ভীমরুলের হুল।
    • মশা ও অন্যান্য পোকামাকড় কামড়।
    • তেলাপোকা।
  • ঔষধ:

    • পেনিসিলিন এবং অন্যান্য অ্যান্টিবায়োটিক।
    • অ্যাসপিরিন এবং অন্যান্য ব্যথানাশক।
  • রাসায়নিক পদার্থ:

    • ল্যাটেক্স (latex)।
    • কিছু ডিটারজেন্ট এবং সাবান।
    • কিছু প্রসাধনী এবং সুগন্ধি।

কেন কিছু লোকের এলার্জি হয়, অন্যদের নয়?

এলার্জি হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ জড়িত, যার মধ্যে প্রধান হলো বংশগতি এবং পরিবেশ।

  • বংশগতি (Genetics): এলার্জি বংশগতভাবে প্রবাহিত হতে পারে। যদি আপনার পরিবারের কোনো সদস্যের (বাবা, মা, ভাই, বোন) এলার্জি থাকে, তবে আপনারও এলার্জি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। নির্দিষ্ট জিন এলার্জির প্রতিক্রিয়ার জন্য শরীরকে আরও সংবেদনশীল করে তুলতে পারে। তবে, জিনগত প্রবণতা থাকা সত্ত্বেও সবার এলার্জি হবে না। পরিবেশগত কারণও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

  • পরিবেশ (Environment): শৈশবের পরিবেশ এবং জীবনের প্রথম দিকের এলার্জেনের সংস্পর্শ এলার্জি বিকাশে প্রভাব ফেলতে পারে। "হাইজিন হাইপোথিসিস" (Hygiene Hypothesis) অনুসারে, শৈশবে জীবাণু এবং সংক্রমণের কম সংস্পর্শে আসা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিপক্ক হতে বাধা দিতে পারে, যার ফলে এটি নিরীহ পদার্থগুলোর প্রতিও অতি সংবেদনশীল হয়ে ওঠে এবং এলার্জি দেখা দিতে পারে।

  • এলার্জেনের সংস্পর্শের মাত্রা এবং সময়কাল: কোনো নির্দিষ্ট এলার্জেনের প্রতি দীর্ঘ সময় ধরে বা উচ্চ মাত্রায় সংস্পর্শে এলে এলার্জি হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে।

  • অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা: অ্যাজমা বা একজিমার মতো অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের এলার্জি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

এলার্জির ঝুঁকি কাদের বেশি?

কিছু নির্দিষ্ট কারণ ব্যক্তিদের এলার্জির ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে পারে:

  • পারিবারিক ইতিহাস: যাদের পরিবারে এলার্জির ইতিহাস রয়েছে।
  • শৈশবে কিছু নির্দিষ্ট সংক্রমণের অভাব: যা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়।
  • দূষিত পরিবেশ: বায়ু দূষণ এবং অন্যান্য পরিবেশগত দূষণ এলার্জির প্রতিক্রিয়াকে আরও খারাপ করতে পারে।
  • নির্দিষ্ট পেশা: কিছু পেশায় (যেমন কৃষি, পশুপালন, রাসায়নিক শিল্প) কর্মরত ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট এলার্জেনের প্রতি বেশি মাত্রায় উন্মুক্ত থাকেন।

এলার্জি নির্ণয় ও চিকিৎসা

এলার্জি নির্ণয়ের জন্য ডাক্তার সাধারণত রোগীর লক্ষণ, চিকিৎসা ইতিহাস এবং শারীরিক পরীক্ষা করেন। এছাড়াও, কিছু বিশেষ পরীক্ষা করা যেতে পারে, যেমন—

  • ত্বকের পরীক্ষা (Skin Prick Test): অল্প পরিমাণে বিভিন্ন এলার্জেন ত্বকের উপর প্রয়োগ করে দেখা হয় কোনটির প্রতি শরীর প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।
  • রক্ত পরীক্ষা (Allergy Blood Test বা IgE Test): রক্তে নির্দিষ্ট এলার্জেনের প্রতি IgE অ্যান্টিবডির মাত্রা পরিমাপ করা হয়।

এলার্জির কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই, তবে এর লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলো এলার্জেনের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা এবং উপসর্গের উপশম করা। চিকিৎসার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে—

  • এলার্জেন পরিহার: যে পদার্থের প্রতি এলার্জি রয়েছে, তা থেকে দূরে থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
  • ঔষধ: অ্যান্টিহিস্টামিন, ডিকনজেস্ট্যান্ট, স্টেরয়েড স্প্রে এবং ক্রিম এলার্জির লক্ষণ কমাতে সাহায্য করে।
  • এলার্জি শট (Immunotherapy): কিছু ক্ষেত্রে, নির্দিষ্ট এলার্জেনের ছোট পরিমাণে ধীরে ধীরে শরীরে প্রবেশ করানো হয় যাতে শরীর ধীরে ধীরে সেটির প্রতি সহনশীলতা তৈরি করতে পারে।

এলার্জি প্রতিরোধে কিছু টিপস


এলার্জি পুরোপুরি নিরাময় করা কঠিন হলেও, কিছু সাধারণ সতর্কতা এবং নিয়ম মেনে চললে এর ঝুঁকি ও তীব্রতা অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

১. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন

  • ঘরবাড়ি পরিষ্কার: নিয়মিত ঘরবাড়ি, বিশেষ করে শোবার ঘর পরিষ্কার রাখুন। মেঝে, কার্পেট এবং আসবাবপত্র ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার করলে ধুলো এবং এলার্জেন দূর হয়।
  • বিছানাপত্র ধোয়া: বিছানার চাদর, বালিশের কভার ও কাঁথা প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার গরম পানিতে ধুয়ে নিন। এতে ধুলোর মাইট (dust mites) এবং অন্যান্য এলার্জেন ধ্বংস হয়।
  • পর্দা ও আসবাব: ভারি পর্দার বদলে হালকা পর্দা ব্যবহার করুন যা সহজে ধোয়া যায়। চামড়ার বা কাঠের আসবাবপত্র ব্যবহার করলে তাতে ধুলো কম জমে।

২. বাতাসের মান নিয়ন্ত্রণ করুন

  • বায়ু চলাচল: ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখুন। স্যাঁতস্যাঁতে ও অন্ধকার পরিবেশ ছত্রাক বা মোল্ড জন্মাতে সাহায্য করে, যা একটি প্রধান এলার্জেন।
  • এয়ার পিউরিফায়ার: সম্ভব হলে HEPA ফিল্টারযুক্ত এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করতে পারেন। এটি বাতাস থেকে ক্ষুদ্র ধূলিকণা, পরাগ রেণু এবং অন্যান্য এলার্জেন ছেঁকে বের করে দেয়।
  • এসি ও ফ্যান পরিষ্কার: নিয়মিত এয়ার কন্ডিশনার (AC) এবং ফ্যানের ফিল্টার পরিষ্কার করুন যাতে জমা হওয়া ধুলো বাতাসে না ছড়ায়।

৩. পরাগ রেণু থেকে সতর্কতা

  • জানালা বন্ধ রাখুন: যে ঋতুতে বাতাসে ফুলের পরাগ রেণুর পরিমাণ বেশি থাকে (যেমন বসন্তকাল), সেই সময়ে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখাই ভালো।
  • মাস্ক ব্যবহার করুন: বাইরে বের হলে, বিশেষ করে বাগান বা পার্কের মতো জায়গায় গেলে মাস্ক ব্যবহার করুন।
  • পোশাক পরিবর্তন: বাইরে থেকে ঘরে ফিরে পোশাক বদলে ফেলুন এবং সম্ভব হলে গোসল করে নিন। এতে শরীর ও পোশাকে লেগে থাকা পরাগ রেণু দূর হয়ে যায়।

৪. পোষা প্রাণী থেকে সাবধানতা

  • নিয়মিত গোসল করানো: ঘরে পোষা প্রাণী (যেমন বিড়াল বা কুকুর) থাকলে তাদের নিয়মিত গোসল করান ও পরিষ্কার রাখুন।
  • শোবার ঘরে প্রবেশ নিষেধ: সম্ভব হলে পোষা প্রাণীকে শোবার ঘরে প্রবেশ করতে দেবেন না। এতে ঘুমের সময় এলার্জেনের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি কমে।
  • হাত ধোয়া: পোষা প্রাণীকে স্পর্শ করার পর সবসময় ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন।

৫. খাদ্য গ্রহণে সতর্কতা

  • এলার্জেন শনাক্তকরণ: যেসব খাবারে আপনার এলার্জি আছে (যেমন: গরুর দুধ, ডিম, বাদাম, চিংড়ি মাছ), সেগুলো শনাক্ত করুন এবং এড়িয়ে চলুন।
  • উপকরণ তালিকা পড়ুন: বাইরে খাওয়ার আগে বা কোনো প্যাকেটজাত খাবার কেনার আগে এর উপকরণ তালিকা (ingredient list) ভালোভাবে পড়ে নিন।
  • ডায়েরি মেইনটেইন: কোন খাবার খাওয়ার পর আপনার এলার্জির লক্ষণ দেখা দিচ্ছে, তা একটি ডায়েরিতে লিখে রাখতে পারেন। এটি আপনার এলার্জির কারণ শনাক্ত করতে সাহায্য করবে।

৬. ব্যক্তিগত যত্ন ও অন্যান্য টিপস

  • পোশাক: সিনথেটিক কাপড়ের বদলে সুতির আরামদায়ক পোশাক পরার চেষ্টা করুন।
  • প্রসাধনী: নতুন কোনো কসমেটিক, লোশন বা সুগন্ধি ব্যবহারের আগে ত্বকের অল্প জায়গায় লাগিয়ে পরীক্ষা করে নিন (প্যাচ টেস্ট)।
  • ধূমপান পরিহার: ধূমপান এবং ধূমপায়ীদের থেকে দূরে থাকুন, কারণ ধোঁয়া এলার্জির সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
  • মানসিক চাপ কমানো: অতিরিক্ত মানসিক চাপও এলার্জির তীব্রতা বাড়াতে পারে। তাই যোগব্যায়াম, মেডিটেশন বা পছন্দের কাজের মাধ্যমে চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন।

সবশেষে, আপনার এলার্জির কারণ বা ট্রিগার কোনটি, তা একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে শনাক্ত করা সবচেয়ে জরুরি। সঠিক কারণ জানতে পারলে সে অনুযায়ী জীবনযাত্রা পরিচালনা করে এলার্জির কষ্ট থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকা সম্ভব।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন