আপনার শিশু কি খেতে চাচ্ছে না?


আপনার শিশু কি খেতে চাচ্ছে না? জেনে নিন কারণ ও করণীয়

শিশুর বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপই বাবা-মায়ের জন্য আনন্দের। কিন্তু এই আনন্দ অনেক সময় উদ্বেগে পরিণত হয় যখন আদরের সোনামণিটি কিছুই খেতে চায় না। প্রায় প্রতিটি বাবা-মা এই সমস্যার সম্মুখীন হন। শিশুর এই খাবার অনীহা নিয়ে দুশ্চিন্তা হওয়াটা স্বাভাবিক, তবে ঘাবড়ে না গিয়ে এর পেছনের কারণগুলো খুঁজে বের করা এবং ধৈর্য ধরে তার সমাধান করা জরুরি।

চলুন জেনে নেওয়া যাক, শিশুরা কেন খেতে চায় না এবং এই অবস্থায় আপনার কী করণীয়।

শিশুদের খেতে না চাওয়ার সাধারণ কারণগুলো

শিশুদের খাবার খেতে না চাওয়ার পেছনে বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক এবং আচরণগত কারণ থাকতে পারে।

১. শারীরিক কারণ:

  • অসুস্থতা: জ্বর, সর্দি-কাশি, পেটে ব্যথা, বা অন্য কোনো অসুস্থতার কারণে শিশুর খাওয়ার রুচি কমে যায়। শরীর অসুস্থ থাকলে বড়দের মতো শিশুদেরও খেতে ইচ্ছে করে না।
  • দাঁত ওঠা: দাঁত ওঠার সময় মাড়িতে ব্যথা বা অস্বস্তির কারণে অনেক শিশু খেতে চায় না। এই সময় তারা শক্ত খাবারের পরিবর্তে তরল বা নরম খাবার পছন্দ করে।
  • পেটের সমস্যা: কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাস বা হজমের সমস্যার কারণেও শিশুর খিদে কমে যেতে পারে।
  • ক্লান্তি: শিশু যদি ক্লান্ত থাকে বা তার ঘুম পায়, তবে সে খাওয়ার চেয়ে ঘুমাতেই বেশি আগ্রহী হবে।

২. বিকাশগত ও আচরণগত কারণ:

  • বৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া: প্রথম বছরে শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধির হার অনেক বেশি থাকে, তাই তাদের খিদেও বেশি থাকে। এক বছরের পর এই বৃদ্ধির গতি কিছুটা কমে যায়, যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের খাবারের চাহিদাও কমে আসে।
  • স্বাধীনতার প্রকাশ: দেড় থেকে দুই বছরের শিশুরা নিজেরা সব কিছু করতে চায়। খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রেও তারা স্বাধীনতা প্রকাশ করতে গিয়ে 'না' বলতে শেখে। এটি তাদের বিকাশেরই একটি অংশ।
  • খাবারে খুঁতখুঁতে হওয়া (Picky Eater): অনেক শিশু একটি নির্দিষ্ট বয়সে খাবারের স্বাদ, গন্ধ বা ধরণ নিয়ে খুব খুঁতখুঁতে হয়ে ওঠে। নতুন কোনো খাবার দেখলেই তারা খেতে আপত্তি করে।
  • মনোযোগের অভাব: চারপাশের জগৎ শিশুদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। খেলার জিনিস, টিভি বা অন্য কোনো দিকে মনোযোগ চলে গেলে তারা খাওয়ার কথা ভুলে যায়।
  • বেশি পরিমাণে দুধ বা জুস: মূল খাবারের আগে শিশু যদি অতিরিক্ত দুধ, ফলের রস বা অন্য কোনো পানীয় পান করে ফেলে, তাহলে তার পেট ভরে যায় এবং সে আর শক্ত খাবার খেতে চায় না।

এই পরিস্থিতিতে আপনার করণীয় কী?

শিশুর खाने অনীহা দেখা দিলে জোর না করে বরং ধৈর্য ধরে কিছু কৌশল অবলম্বন করুন।

১. ধৈর্য ধরুন, জোর করবেন না: শিশুকে খাবার নিয়ে জোর করলে খাবারের প্রতি তার একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।

২. একটি নির্দিষ্ট রুটিন তৈরি করুন: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে নাস্তা, দুপুরের খাবার ও রাতের খাবার দিন। এতে শিশুর শরীর ওই সময়ে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে।

৩. পরিবারের সবাই একসাথে খান: শিশুদের অনুকরণ করার প্রবণতা খুব বেশি। পরিবারের সবাইকে একসাথে খেতে দেখলে সেও খেতে উৎসাহিত হবে।

৪. অল্প পরিমাণে বিভিন্ন ধরণের খাবার দিন: একবারে বেশি খাবার না দিয়ে অল্প পরিমাণে দিন। প্লেটে বিভিন্ন রঙের শাক-সবজি ও ফল দিয়ে সাজিয়ে দিন, যেন তার কাছে খাবারটি আকর্ষণীয় মনে হয়।

৫. খাবারকে আকর্ষণীয় করে তুলুন: খাবার দিয়ে বিভিন্ন আকৃতি, যেমন - হাসিমুখ বা ফুল তৈরি করে দিন। এতে শিশু খেলতে খেলতে খেতে আগ্রহী হবে।

৬. খাবার সময় টিভি বা মোবাইল বন্ধ রাখুন: খাওয়ার সময়টুকু শুধুমাত্র খাওয়ার জন্যই রাখুন। টিভি, মোবাইল বা অন্য কোনো খেলনা শিশুকে খেতে অমনোযোগী করে তোলে।

৭. খাবারের আগে দুধ বা জুস নয়: মূল খাবারের অন্তত এক থেকে দেড় ঘণ্টা আগে শিশুকে দুধ বা অন্য কোনো ভারী পানীয় দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।

৮. শিশুকে যুক্ত করুন: খাবার তৈরির সময় বা পরিবেশনের সময় শিশুকে সাথে রাখুন। কোন বাটিতে খাবে, সেটা তাকেই পছন্দ করতে দিন। এতে খাবারের প্রতি তার আগ্রহ বাড়বে।

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন?

সাধারণত খাদ্যে অরুচি একটি সাময়িক সমস্যা। তবে কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। যেমন:

  • শিশুর ওজন যদি ক্রমাগত কমতে থাকে বা বয়স অনুযায়ী ওজন না বাড়ে।
  • শিশু যদি পানিশূন্যতার লক্ষণে (যেমন - খুব কম প্রস্রাব করা, মুখ শুকিয়ে যাওয়া) ভোগে।
  • ক্রমাগত বমি বা ডায়রিয়া হলে।
  • খাবার গিলতে কষ্ট হলে বা গলায় আটকে গেলে।
  • শিশু যদি অনেক বেশি নিস্তেজ হয়ে পড়ে।

শেষ কথা

মনে রাখবেন, প্রতিটি শিশুই আলাদা এবং তাদের খাওয়ার অভ্যাসও ভিন্ন। আপনার সন্তানের খাবারের চাহিদাকে সম্মান করুন। তার বেড়ে ওঠার এই যাত্রায় একজন উদ্বিগ্ন অভিভাবক না হয়ে ধৈর্যশীল সঙ্গী হোন। আপনার ভালোবাসা এবং সঠিক পরিচর্যাই তাকে স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন