চোখের কোণে ময়লা বা শ্লেষ্মা: কারণ, প্রতিকার এবং বিস্তারিত আলোচনা





চোখ আমাদের শরীরের সবচেয়ে সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে একটি। তাই চোখের যেকোনো সমস্যাই আমাদের ভাবিয়ে তোলে। অনেকেই সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর বা দিনের বেলাতেও চোখের কোণে সাদা বা হালকা হলুদ বর্ণের ময়লা বা পিচুটি জমতে দেখেন। আপনার মতো অনেকেরই এই সমস্যাটি ছোটবেলা থেকে বিদ্যমান। চলুন, এই সমস্যার গভীর থেকে এর কারণ, প্রতিকার এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

প্রথমেই বোঝা যাক, চোখের এই ময়লা বা পিচুটি আসলে কী?

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় চোখের এই ময়লাকে 'রিউম' (Rheum) বলা হয়। এটি মূলত আমাদের চোখের অশ্রু, শ্লেষ্মা (mucus), তেল (meibum), মৃত কোষ এবং বাইরের ধুলোবালির একটি মিশ্রণ।

আমাদের চোখের সুরক্ষার জন্য একটি পাতলা অশ্রুর আস্তরণ থাকে, যা টিয়ার ফিল্ম (Tear Film) নামে পরিচিত। এই টিয়ার ফিল্মের তিনটি স্তর রয়েছে:

  1. তেল বা লিপিড স্তর (Lipid Layer): এটি সবচেয়ে বাইরের স্তর। চোখের পাতার মেবোমিয়ান গ্রন্থি (Meibomian glands) থেকে এই তেল নিঃসৃত হয়, যা অশ্রু যেন দ্রুত শুকিয়ে না যায় তা নিশ্চিত করে।
  2. জলীয় স্তর (Aqueous Layer): এটি মাঝের স্তর এবং অশ্রুর সবচেয়ে বড় অংশ। ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি (Lacrimal glands) থেকে এটি তৈরি হয়। এই স্তর চোখকে আর্দ্র রাখে এবং ধুয়ে পরিষ্কার করে।
  3. শ্লেষ্মা বা মিউকাস স্তর (Mucus Layer): এটি সবচেয়ে ভেতরের স্তর, যা কনজাংটিভা (Conjunctiva) থেকে তৈরি হয়। এটি অশ্রুকে চোখের সারফেসে সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে।

যখন আমরা ঘুমাই, তখন আমরা চোখের পলক ফেলি না। ফলে এই সময়ে চোখের কোণে এই মিশ্রণটি শুকিয়ে জমে পিচুটিতে পরিণত হয়। তাই সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর অল্প পরিমাণে পিচুটি থাকাটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কিন্তু যদি এর পরিমাণ অতিরিক্ত হয়, রঙে পরিবর্তন আসে বা দিনের বেলাতেও ক্রমাগত জমতে থাকে, তবে এর পেছনে কিছু কারণ থাকতে পারে।

অতিরিক্ত চোখ দিয়ে ময়লা বের হওয়ার সম্ভাব্য কারণসমূহ

আপনার বর্ণনা অনুযায়ী, চোখ ঘষলে বা মুখ ধুলে সাদা শ্লেষ্মার মতো পদার্থ বের হয়, যা ছোটবেলা থেকেই হচ্ছে। এর পেছনে এক বা একাধিক কারণ থাকতে পারে।

১. এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস (Allergic Conjunctivitis):

এটি অতিরিক্ত চোখের ময়লা জমার অন্যতম প্রধান কারণ। আপনার ক্ষেত্রে এটি হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, কারণ চোখ ঘষার পর সমস্যাটি বাড়ে।

  • কারণ: ধুলোবালি, ফুলের রেণু, حیواناتের লোম, কসমেটিকস বা কোনো নির্দিষ্ট রাসায়নিকের সংস্পর্শে এলে আমাদের শরীর হিস্টামিন (Histamine) নামক একটি পদার্থ নিঃসরণ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় চোখে চুলকানি, জ্বালাপোড়া, পানি পড়া এবং সাদা, দড়ির মতো বা শ্লেষ্মাজাতীয় ময়লা জমতে পারে।
  • লক্ষণ: চোখে প্রচণ্ড চুলকানি, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, পানি পড়া এবং সাদা শ্লেষ্মা জমা।

২. ড্রাই আই সিনড্রোম (Dry Eye Syndrome):

চোখে পর্যাপ্ত পরিমাণে অশ্রু তৈরি না হলে বা অশ্রুর গুণগত মান ভালো না হলে চোখ শুষ্ক হয়ে যায়।

  • কারণ: শরীরকে আর্দ্র রাখার একটি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে চোখ তখন অতিরিক্ত শ্লেষ্মা তৈরি করে। এই শ্লেষ্মা চোখের কোণে জমতে পারে। দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার বা মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা, এসি রুমে বেশি সময় কাটানো, বয়সজনিত পরিবর্তন বা কিছু ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ড্রাই আই সিনড্রোম হতে পারে।
  • লক্ষণ: চোখে জ্বালাপোড়া, কিছু আটকে আছে এমন অনুভূতি, আলোর দিকে তাকাতে কষ্ট এবং মাঝে মাঝে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া। এর সাথে সাদা শ্লেষ্মাও থাকতে পারে।

৩. ব্লেফারাইটিস (Blepharitis):

এটি হলো চোখের পাতার প্রদাহ। চোখের পাতার গোড়ায় যেখানে পাপড়ি গজায়, সেখানকার তৈল গ্রন্থিগুলো বন্ধ হয়ে গেলে এই প্রদাহ হয়।

  • কারণ: ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ বা ত্বকের কিছু রোগের (যেমন- সেবোরিক ডার্মাটাইটিস) কারণে এটি হতে পারে।
  • লক্ষণ: চোখের পাতা লাল হয়ে যাওয়া, ফুলে যাওয়া, চুলকানি, পাপড়ির গোড়ায় খুশকির মতো জমা, চোখে জ্বালাপোড়া এবং সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর চোখের পাতা একে অপরের সাথে লেগে থাকা। এর ফলেও চোখে অতিরিক্ত ময়লা জমতে পারে।

৪. অশ্রুনালী বন্ধ হয়ে যাওয়া (Blocked Tear Duct):

চোখের ভেতরের কোণায় অবস্থিত অশ্রুনালী (Tear Duct) দিয়ে চোখের পানি নাকে চলে যায়। কোনো কারণে এই নালী আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে অশ্রু সঠিকভাবে নিষ্কাশিত হতে পারে না।

  • কারণ: জন্মগতভাবে, বয়সের কারণে, সংক্রমণ বা আঘাতের ফলে অশ্রুনালী বন্ধ হতে পারে।
  • লক্ষণ: চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়া, চোখ বারবার সংক্রমিত হওয়া এবং চোখের কোণে শ্লেষ্মা বা পুঁজের মতো জমা।

৫. সংক্রমণজনিত কনজাংটিভাইটিস (Infectious Conjunctivitis):

যাকে আমরা সাধারণত 'জয় বাংলা' বা 'চোখ ওঠা' বলি।

  • ব্যাকটেরিয়াল কনজাংটিভাইটিস: এক্ষেত্রে সাধারণত ঘন, হলুদ বা সবুজাভ রঙের পুঁজ বা ময়লা জমে এবং সকালে চোখের পাতা আটকে যায়।
  • ভাইরাল কনজাংটিভাইটিস: এক্ষেত্রে পানি পড়ার পরিমাণ বেশি থাকে এবং ময়লা সাধারণত সাদা বা পরিষ্কার হয়।
  • আপনার সমস্যাটি যেহেতু দীর্ঘদিনের এবং সাদা শ্লেষ্মার মতো, তাই এটি তীব্র সংক্রমণের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এলার্জি বা ড্রাই আই হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

এই সমস্যার প্রতিকার ও করণীয় কী?

যেহেতু আপনার সমস্যাটি দীর্ঘদিনের, তাই একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। তবে তার আগে কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললে আপনি উপকার পেতে পারেন।

ঘরোয়া যত্ন ও প্রতিরোধ:

  1. চোখ ঘষা থেকে বিরত থাকুন: চোখ চুলকালে বা অস্বস্তি হলে সরাসরি হাত দিয়ে ঘষবেন না। এটি এলার্জির প্রতিক্রিয়া বাড়িয়ে দেয় এবং হাতে থাকা জীবাণু চোখে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
  2. চোখ পরিষ্কার রাখুন: দিনে দুই থেকে তিনবার পরিষ্কার, ঠান্ডা পানি দিয়ে আলতো করে চোখ ধুয়ে নিন। একটি পরিষ্কার, নরম কাপড় বা কটন বল ব্যবহার করে চোখের কোণা আলতোভাবে পরিষ্কার করতে পারেন। সবসময় ভেতর থেকে বাইরের দিকে মুছবেন।
  3. উষ্ণ সেঁক দিন (Warm Compress): একটি পরিষ্কার কাপড় গরম পানিতে ভিজিয়ে, নিংড়ে নিয়ে বন্ধ চোখের ওপর ৫-১০ মিনিট রাখুন। এটি ব্লেফারাইটিস এবং ড্রাই আইয়ের ক্ষেত্রে খুবই উপকারী। এটি চোখের পাতার তৈল গ্রন্থিগুলোকে খুলে দিতে সাহায্য করে এবং ময়লা নরম করে পরিষ্কার করা সহজ করে তোলে।
  4. এলার্জি সৃষ্টিকারী জিনিস এড়িয়ে চলুন: আপনার যদি এলার্জির সমস্যা থাকে, তবে কীসে এলার্জি হয় তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। বাইরে গেলে সানগ্লাস ব্যবহার করুন, যা চোখকে ধুলোবালি ও রোদ থেকে রক্ষা করবে। ঘরে কার্পেট ও বিছানাপত্র নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন।
  5. স্ক্রিন টাইম ম্যানেজমেন্ট: আপনি যদি দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার বা মোবাইল ব্যবহার করেন, তবে "২০-২০-২০" নিয়মটি অনুসরণ করুন। প্রতি ২০ মিনিট পর পর, ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরের কোনো কিছুর দিকে তাকান। এটি চোখের ওপর চাপ কমায় এবং ড্রাই আই প্রতিরোধ করে।
  6. পর্যাপ্ত পানি পান করুন: শরীরকে হাইড্রেটেড বা আর্দ্র রাখতে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন। এটি ড্রাই আই সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
  7. লুব্রিকেটিং আই ড্রপস (Artificial Tears): চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বা স্টেরয়েড ড্রপ ব্যবহার করবেন না। তবে আপনি ওভার-দ্য-কাউন্টার (OTC) লুব্রিকেটিং আই ড্রপস বা আর্টিফিশিয়াল টিয়ার্স ব্যবহার করতে পারেন, যা ড্রাই আইয়ের ক্ষেত্রে স্বস্তি দেয়।

কখন অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন?

যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চোখের ময়লা ক্ষতিকর নয়, তবে কিছু লক্ষণ দেখলে দেরি না করে অবশ্যই চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া উচিত:

  • যদি চোখের ময়লার রঙ হলুদ, সবুজ বা ধূসর হয় (ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের লক্ষণ)।
  • চোখে তীব্র ব্যথা বা জ্বালাপোড়া হলে।
  • দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে গেলে বা কমে গেলে।
  • আলোর দিকে তাকাতে شدید কষ্ট হলে (Photophobia)।
  • চোখ বা চোখের পাতা অতিরিক্ত লাল হয়ে গেলে বা ফুলে গেলে।
  • চোখে কোনো ধরনের আঘাত পেলে।
  • ঘরোয়া প্রতিকারে কয়েক দিনেও কোনো উন্নতি না হলে।

উপসংহার

আপনার দীর্ঘদিনের সমস্যাটি সম্ভবত এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস বা ড্রাই আই সিনড্রোমের সাথে সম্পর্কিত। চোখ ঘষার অভ্যাস এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। উপরে আলোচিত ঘরোয়া পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করলে আপনি কিছুটা আরাম পেতে পারেন।

তবে, সঠিক কারণ নির্ণয় এবং স্থায়ী সমাধানের জন্য একজন অভিজ্ঞ চক্ষু বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলা অপরিহার্য। তিনি আপনার চোখ পরীক্ষা করে সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করবেন এবং সেই অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা, যেমন - এলার্জির জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন ড্রপস, ড্রাই আইয়ের জন্য বিশেষ লুব্রিকেন্টস বা ব্লেফারাইটিসের জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসা প্রদান করতে পারবেন। চোখের যত্ন নিন, সুস্থ থাকুন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন