বাবা-মায়ের জন্য অন্যতম চিন্তার একটি বিষয় হলো সন্তানের খাওয়া-দাওয়া। অনেক শিশুই খাবার দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয়, খেতে চায় না বা পছন্দের নির্দিষ্ট কিছু খাবার ছাড়া অন্য কিছু মুখে তুলতে চায় না। এই সমস্যাটি প্রায় প্রতি ঘরেই কমবেশি দেখা যায়। "আমার বাচ্চাটা কিছুই খেতে চায় না" - এই আক্ষেপ অনেক মায়ের। তবে, এই সমস্যার পেছনে কিছু নির্দিষ্ট কারণ থাকে এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এর সমাধান করা সম্ভব। এই ব্লগ পোস্টে আমরা শিশুদের খাবারের অনিহার কারণ, এর পেছনের মনস্তাত্ত্বিক দিক এবং এই সমস্যা মোকাবিলায় বাবা-মায়ের করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
কেন বাচ্চারা খেতে চায় না? কারণগুলো চিহ্নিত করুন
শিশুদের খাবারের প্রতি এই অনাগ্রহের পেছনে এক বা একাধিক কারণ থাকতে পারে। সমাধানের পথে প্রথম ধাপ হলো মূল কারণটি খুঁজে বের করা।
১. শারীরিক সমস্যা:
অনেক সময় শারীরিক অসুস্থতার কারণে শিশুদের খাওয়ার রুচি কমে যায়। যেমন:
- পেটের সমস্যা: কৃমি, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়ার কারণে পেটে ব্যথা হতে পারে, যা তাদের খাওয়ার ইচ্ছাকে কমিয়ে দেয়।
- জিঙ্কের অভাব: শরীরে জিঙ্কের ঘাটতি হলে খাবারের রুচি কমে যায়। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল ও বাদামে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক থাকে।
- সাধারণ অসুস্থতা: জ্বর, সর্দি-কাশি, কানে ব্যথা বা গলাব্যথার মতো সাধারণ অসুস্থতাও শিশুর খাবারের প্রতি অনীহা তৈরি করে।
- দাঁত ওঠা: দাঁত ওঠার সময় মাড়িতে ব্যথা ও অস্বস্তির কারণে শিশুরা খেতে চায় না।
২. মানসিক ও আচরণগত কারণ:
- জোর করে খাওয়ানো: অনেক বাবা-মা শিশুকে জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। এটি শিশুর মনে খাওয়ার প্রতি একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। খাওয়ার সময়টা তার কাছে আনন্দের বদলে শাস্তির মতো মনে হয়।
- মনোযোগের অভাব: খাওয়ার সময় টিভি, মোবাইল ফোন বা অন্য কোনো ডিভাইসের প্রতি আসক্তি শিশুর মনোযোগ খাবার থেকে সরিয়ে দেয়। ফলে সে খাবারের স্বাদ বা পরিমাণ বুঝতে পারে না এবং খাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
- খাবারের প্রতি একঘেয়েমি: প্রতিদিন একই ধরনের খাবার বা একই স্বাদের খাবার দিলে শিশুরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। খাবারে বৈচিত্র্য না থাকা অনিহার একটি বড় কারণ।
- পরিবেশ: খাওয়ার জন্য একটি শান্ত ও মনোরম পরিবেশের প্রয়োজন। পারিবারিক অশান্তি বা কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে শিশু স্বাচ্ছন্দ্যে খেতে পারে না।
- স্বাধীনতার প্রকাশ: বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিশুরা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করতে শেখে। অনেক সময় তারা 'না' বলে নিজেদের ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং খাবার প্রত্যাখ্যান করা তারই একটি অংশ হতে পারে।
৩. খাদ্যাভ্যাস সংক্রান্ত কারণ:
- ঘন ঘন খাবার দেওয়া: দুটি প্রধান খাবারের মাঝে অল্প সময়ের ব্যবধানে বারবার হালকা খাবার বা স্ন্যাকস দিলে শিশুর মূল খাবারের সময় খিদে থাকে না।
- বাইরের খাবারের প্রতি আকর্ষণ: চিপস, চকোলেট, জুস বা অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রতি আসক্তি শিশুর বাড়ির তৈরি স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি অনাগ্রহ তৈরি করে।
- খাবারের ধরন: অনেক সময় খাবারের ঘনত্ব, তাপমাত্রা বা গন্ধ শিশুর পছন্দ নাও হতে পারে। খুব বেশি গরম, ঠাণ্ডা বা তীব্র গন্ধযুক্ত খাবার তারা প্রত্যাখ্যান করতে পারে।
বাবা-মায়ের করণীয়: ধৈর্য ও কৌশলের সমন্বয়ে সমাধান
শিশুর খাবারের অনিহা দূর করার জন্য জোর খাটানো কোনো সমাধান নয়। বরং ধৈর্য, ভালোবাসা এবং কিছু কৌশল অবলম্বন করলে সহজেই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
১. খাবারের সময়কে আনন্দময় করে তুলুন:
খাওয়ার সময়টাকে যুদ্ধের ময়দান না বানিয়ে আনন্দদায়ক করে তুলুন। খাওয়ার সময় শিশুর সাথে গল্প করুন, মজার ছড়া বলুন বা তার পছন্দের কোনো খেলনাকে সঙ্গে নিয়ে খেলাচ্ছলে খাওয়ান। পরিবারের সবাই একসাথে বসে খেলে শিশু খেতে উৎসাহিত হয়। তাকে নিজের হাতে খেতে দিন, এমনকি যদি সে কিছুটা ময়লাও করে ফেলে। এটি তাকে খাবারের প্রতি আগ্রহী করে তুলবে।
২. খাবারে আনুন বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব:
প্রতিদিন একই রকম খাবার না দিয়ে খাবারে বৈচিত্র্য আনুন। খাবারের রঙ, আকার এবং পরিবেশনের ধরনে নতুনত্ব আনলে শিশুরা আকৃষ্ট হয়।
- আকর্ষণীয় পরিবেশন: খাবারটি দেখতে আকর্ষণীয় হলে শিশুর খাওয়ার আগ্রহ বাড়ে। গাজর বা শসাকে বিভিন্ন আকারে (যেমন: ফুল, তারা) কেটে দিন। ভাতের সাথে সবজি মিশিয়ে রঙিন বল তৈরি করতে পারেন।
- বিভিন্ন ধরনের রেসিপি: একই সবজি বা ডাল বিভিন্নভাবে রান্না করে দিন। যেমন, ডালের বড়া, সবজির কাটলেট বা স্যুপ তৈরি করে দিতে পারেন। দুধ খেতে না চাইলে দুধ দিয়ে পুডিং, সেমাই বা ফিরনি তৈরি করে দিন।
- নতুন খাবারের সাথে পরিচয়: শিশুকে নতুন খাবারের সাথে ধীরে ধীরে পরিচয় করান। প্রথমে তার পছন্দের খাবারের সাথে অল্প পরিমাণে নতুন খাবার দিন। একবারে অনেক বেশি নতুন খাবার প্লেটে তুলে দেবেন না।
৩. শিশুর পছন্দকে গুরুত্ব দিন:
শিশুর পছন্দের স্বাস্থ্যকর খাবারগুলো তার খাদ্যতালিকায় রাখুন। দুটি স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে তাকে একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দিন। যেমন: "তুমি কি আজকে ভাতের সাথে মুরগির মাংস খাবে নাকি মাছ খাবে?" - এই ধরনের প্রশ্ন করলে সে মনে করবে তার মতামতের গুরুত্ব আছে এবং সে খেতে আগ্রহী হবে।
৪. জোর করে খাওয়ানো থেকে বিরত থাকুন:
কোনো অবস্থাতেই শিশুকে জোর করে খাওয়াবেন না। যদি সে খেতে না চায়, তাহলে প্লেট সরিয়ে নিন এবং পরবর্তী খাবারের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। জোর করলে খাওয়ার প্রতি তার ভয় ও আতঙ্ক তৈরি হতে পারে। মনে রাখবেন, খিদে পেলে শিশু নিজে থেকেই খাবে।
৫. সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন:
- নির্দিষ্ট সময়ে খাবার: প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে শিশুকে খাওয়ানোর অভ্যাস করুন। এতে তার শরীর সেই সময়ে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে।
- স্ন্যাকসের পরিমাণ কমানো: মূল খাবারের অন্তত এক থেকে দেড় ঘণ্টা আগে কোনো ধরনের ভারী স্ন্যাকস দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম: শিশুকে খেলাধুলা ও দৌড়ঝাঁপের সুযোগ করে দিন। শারীরিক পরিশ্রম করলে খিদে বাড়বে এবং সে খেতে চাইবে।
- ডিভাইস মুক্ত রাখুন: খাওয়ার সময় টিভি, মোবাইল বা ট্যাব完全 বন্ধ রাখুন। শিশুর সম্পূর্ণ মনোযোগ যেন খাবারের দিকে থাকে।
৬. রান্নায় শিশুকে সঙ্গী করুন:
বাজার করার সময় বা রান্না করার সময় শিশুকে সাথে রাখুন। তাকে বিভিন্ন শাকসবজি ও ফলের নাম শেখান, তাদের রঙ ও গন্ধ চেনান। রান্নার সহজ কিছু কাজে, যেমন - মটরশুঁটি ছাড়ানো বা সালাদ বানানোতে তাকে সাহায্য করতে বলুন। এতে খাবারের প্রতি তার আগ্রহ জন্মাবে।
৭. ধৈর্য ধরুন এবং ইতিবাচক থাকুন:
মনে রাখবেন, শিশুর খাবারের অভ্যাস রাতারাতি পরিবর্তন হবে না। এর জন্য সময় ও ধৈর্যের প্রয়োজন। শিশু অল্প খেলেও তার প্রশংসা করুন। খাবার নিয়ে তার সামনে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য বা দুশ্চিন্তা প্রকাশ করবেন না। আপনার ইতিবাচক মনোভাব তাকেও প্রভাবিত করবে।
কিছু স্বাস্থ্যকর ও আকর্ষণীয় রেসিপি
পিকি ইটার বা খুঁতখুঁতে স্বভাবের শিশুদের জন্য কিছু সহজ ও পুষ্টিকর রেসিপি নিচে দেওয়া হলো:
- সবজি দিয়ে চিকেন নাগেট: মুরগির কিমার সাথে গাজর, বরবটি, আলু সেদ্ধ করে মেখে নিন। এর সাথে সামান্য আদা-রসুন বাটা, লবণ ও গোলমরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে নাগেটের আকারে গড়ে ডিমে ডুবিয়ে ব্রেডক্রাম্বে গড়িয়ে ডুবোতেলে বা এয়ার ফ্রায়ারে ভেজে দিন।
- রঙিন পরোটা: আটা বা ময়দা মাখানোর সময় গাজর বা বিটের রস ব্যবহার করে রঙিন পরোটা তৈরি করতে পারেন। এর ভেতরে পনির বা আলুর পুর দিয়ে দিলে তা আরও সুস্বাদু হবে।
- ফলের কাস্টার্ড: দুধ, চিনি ও কাস্টার্ড পাউডার দিয়ে কাস্টার্ড তৈরি করে নিন। ঠাণ্ডা হলে বিভিন্ন ধরনের মৌসুমী ফল (যেমন: আম, কলা, আপেল, বেদানা) ছোট ছোট টুকরো করে মিশিয়ে দিন।
- ডিম-সুজির প্যানকেক: একটি ডিমের সাথে পরিমাণমতো সুজি, সামান্য দুধ, লবণ বা চিনি (স্বাদমতো) মিশিয়ে একটি মসৃণ মিশ্রণ তৈরি করুন। প্যানে সামান্য তেল বা মাখন দিয়ে ছোট ছোট প্যানকেক ভেজে দিন।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?
উপরোক্ত কৌশলগুলো প্রয়োগ করার পরেও যদি শিশুর খাবারে অনীহা না কমে এবং তার ওজন ঠিকমতো না বাড়ে, তাহলে অবশ্যই একজন শিশু বিশেষজ্ঞ বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন। চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কোনো শারীরিক সমস্যা আছে কিনা তা নির্ণয় করবেন এবং সঠিক পরামর্শ দেবেন।
পরিশেষে বলা যায়, শিশুর খাবারের অনিহা একটি সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। বাবা-মায়ের ধৈর্য, ভালোবাসা ও সঠিক কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। মনে রাখবেন, প্রতিটি শিশুই স্বতন্ত্র এবং তাদের বেড়ে ওঠার ধরনও ভিন্ন। তাই অন্যের শিশুর সাথে নিজের শিশুর তুলনা না করে, তার নিজস্ব গতিতে বেড়ে উঠতে সাহায্য করুন এবং একটি সুস্থ ও সুন্দর শৈশব উপহার দিন।