বাচ্চাদের অ্যালার্জি: কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার

 


বাচ্চাদের অ্যালার্জি: কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার

শিশুদের স্বাস্থ্য নিয়ে বাবা-মায়েরা সবসময়ই চিন্তিত থাকেন। বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতার মধ্যে অ্যালার্জি একটি অন্যতম সাধারণ সমস্যা যা অনেক শিশুই সম্মুখীন হয়। অ্যালার্জি শিশুদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারে এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশেও প্রভাব ফেলতে পারে। তাই বাচ্চাদের অ্যালার্জি সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা, এর কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে জানা প্রত্যেক বাবা-মায়ের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

অ্যালার্জি কী?

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, অ্যালার্জি হলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। যখন কোনো ক্ষতিকর নয় এমন পদার্থ, যেমন পরাগ রেণু, ধুলোবালি, কোনো বিশেষ খাবার অথবা পোকামাকড়ের কামড়, শরীরের সংস্পর্শে আসে, তখন কিছু শিশুর শরীর এটিকে ক্ষতিকর জীবাণু হিসেবে ভুল করে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এই প্রতিক্রিয়ার ফলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা যায়, যাকে আমরা অ্যালার্জি বলে থাকি। যে পদার্থটি অ্যালার্জির সৃষ্টি করে, তাকে অ্যালার্জেন (Allergen) বলা হয়।

শিশুদের মধ্যে অ্যালার্জির সাধারণ কারণ:

শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে অ্যালার্জি হতে পারে। এর মধ্যে কিছু প্রধান কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:

  • খাবার: কিছু বিশেষ খাবার শিশুদের মধ্যে অ্যালার্জির একটি প্রধান কারণ। গরুর দুধ, ডিম, বাদাম, সয়াবিন, গম এবং মাছ হলো শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী খাবার। অনেক সময় নির্দিষ্ট ফল বা সবজিও অ্যালার্জির কারণ হতে পারে।
  • পরিবেশগত অ্যালার্জেন: পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান যেমন ধুলোবালি, পোষা প্রাণীর লোম, ফুলের পরাগ রেণু, ঘাস, আগাছা, এবং মোল্ড (ছত্রাক) শিশুদের মধ্যে অ্যালার্জির সৃষ্টি করতে পারে। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে এই ধরনের অ্যালার্জির প্রকোপ বাড়তে দেখা যায়।
  • ত্বকের সংস্পর্শে আসা অ্যালার্জেন: কিছু রাসায়নিক পদার্থ, সাবান, ডিটারজেন্ট, লোশন, বা পোকামাকড়ের কামড় থেকেও শিশুদের অ্যালার্জি হতে পারে। কিছু নির্দিষ্ট ধাতুর গয়না পরলেও ত্বকে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
  • শ্বাসকষ্ট সৃষ্টিকারী অ্যালার্জেন: কিছু অ্যালার্জেন শ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট, কাশি বা হাঁপানির মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে। ধোঁয়া, গাড়ির ধোঁয়া এবং তীব্র গন্ধও কিছু শিশুর শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে।
  • জেনেটিক কারণ: যদি পরিবারের অন্য সদস্যদের অ্যালার্জির ইতিহাস থাকে, তাহলে শিশুর অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। জিনগত প্রবণতা অ্যালার্জির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শিশুদের অ্যালার্জির সাধারণ লক্ষণ:

শিশুদের মধ্যে অ্যালার্জির লক্ষণ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে এবং তা হালকা থেকে গুরুতর পর্যন্ত হতে পারে। কিছু সাধারণ লক্ষণ নিচে উল্লেখ করা হলো:

  • ত্বকের লক্ষণ:

    • চুলকানি: ত্বকের বিভিন্ন অংশে তীব্র চুলকানি হতে পারে।
    • লালচে ভাব: ত্বকে লালচে দাগ বা ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।
    • ফোলাভাব: ত্বক ফুলে যেতে পারে, বিশেষ করে চোখ, মুখ বা ঠোঁটের চারপাশে।
    • চামড়া ওঠা: ত্বকের কিছু অংশ শুকিয়ে ফেটে যেতে পারে বা চামড়া উঠতে পারে।
    • একজিমা (Eczema): ত্বকের প্রদাহ এবং চুলকানিযুক্ত ফুসকুড়ি দেখা দেওয়া, যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
    • আর্টিকেরিয়া (Hives): ত্বকে ছোট ছোট লাল বা সাদা রঙের ফোলা ফোলা দাগ দেখা দেওয়া এবং চুলকানো।
  • শ্বাসতন্ত্রের লক্ষণ:

    • নাক দিয়ে জল পড়া বা বন্ধ নাক: সর্দি বা নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া অ্যালার্জির একটি সাধারণ লক্ষণ।
    • হাঁচি: ঘন ঘন হাঁচি আসা।
    • কাশি: শুকনো কাশি বা শ্বাসকষ্টের সাথে কাশি হতে পারে।
    • শ্বাসকষ্ট: শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া বা বুকের মধ্যে সাঁইসাঁই শব্দ হওয়া (হুইজিং)।
    • গলা ব্যথা বা খুসখুস করা।
  • চোখের লক্ষণ:

    • চোখে চুলকানি: চোখের ভেতরে বা চারপাশে চুলকানি অনুভব হওয়া।
    • চোখ দিয়ে জল পড়া: অতিরিক্ত পরিমাণে জল পড়া।
    • চোখ লাল হয়ে যাওয়া: চোখের সাদা অংশ লালচে হয়ে যাওয়া।
    • চোখের পাতা ফুলে যাওয়া।
  • পেটের লক্ষণ:

    • বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া।
    • পেটে ব্যথা বা অস্বস্তি।
    • ডায়রিয়া।
  • গুরুতর অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া (অ্যানাফিল্যাক্সিস): এটি একটি জীবন-হুমকির কারণ হতে পারে এবং এর লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:

    • শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হওয়া।
    • গলা বা মুখ ফুলে যাওয়া।
    • দ্রুত হৃদস্পন্দন।
    • মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
    • রক্তচাপ কমে যাওয়া।

যদি কোনো শিশুর মধ্যে এই ধরনের গুরুতর লক্ষণ দেখা যায়, তবে অবিলম্বে மருத்துவ सहायता নেওয়া জরুরি।

কীভাবে বুঝবেন শিশুর অ্যালার্জি আছে?

যদি আপনার শিশুর মধ্যে অ্যালার্জির কোনো লক্ষণ দেখা যায়, তবে একজন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ডাক্তার সাধারণত নিম্নলিখিত পদ্ধতির মাধ্যমে অ্যালার্জি নির্ণয় করে থাকেন:

  • শারীরিক পরীক্ষা: ডাক্তার শিশুর শারীরিক পরীক্ষা করবেন এবং লক্ষণগুলি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন।
  • চিকিৎসা ইতিহাস: ডাক্তার শিশুর এবং পরিবারের অ্যালার্জির ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করবেন।
  • অ্যালার্জি টেস্টিং: কিছু ক্ষেত্রে অ্যালার্জির কারণ শনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করানো হতে পারে, যেমন:
    • ত্বকের পরীক্ষা (Skin Prick Test): এই পরীক্ষায় অল্প পরিমাণে বিভিন্ন অ্যালার্জেন ত্বকের উপর রেখে ছোট সূঁচ দিয়ে সামান্য খোঁচা দেওয়া হয়। যদি কোনো অ্যালার্জেনের প্রতি শিশুর সংবেদনশীলতা থাকে, তবে সেই জায়গায় লালচে ভাব বা ফোলাভাব দেখা দেবে।
    • রক্ত পরীক্ষা (Blood Test): রক্তের মাধ্যমে নির্দিষ্ট অ্যালার্জেনের প্রতি অ্যান্টিবডির মাত্রা পরিমাপ করা যায়। বিশেষত ত্বকের পরীক্ষা করা সম্ভব না হলে এই পরীক্ষা করা হয়।

শিশুদের অ্যালার্জির চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা:

শিশুদের অ্যালার্জির সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব না হলেও, সঠিক চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর লক্ষণগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং শিশুর জীবনযাত্রার মান উন্নত করা যায়। চিকিৎসার প্রধান উপায়গুলি হলো:

  • অ্যালার্জেন পরিহার: অ্যালার্জির মূল চিকিৎসা হলো যে পদার্থটির কারণে অ্যালার্জি হচ্ছে, সেটি এড়িয়ে চলা। খাবার অ্যালার্জির ক্ষেত্রে সেই খাবারগুলি শিশুর খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। পরিবেশগত অ্যালার্জির ক্ষেত্রে ধুলোবালি, পোষা প্রাণীর সংস্পর্শ ইত্যাদি এড়িয়ে চলতে হবে।

  • ওষুধ: অ্যালার্জির লক্ষণগুলি উপশম করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যেমন:

    • অ্যান্টিহিস্টামিন (Antihistamine): চুলকানি, হাঁচি, নাক দিয়ে জল পড়া ইত্যাদি লক্ষণ কমাতে সাহায্য করে।
    • কॉर्टিকোস্টেরয়েড (Corticosteroid): প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। এটি ক্রিম, স্প্রে বা খাওয়ার ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
    • ডিকনজেস্ট্যান্ট (Decongestant): নাক বন্ধ হয়ে গেলে এটি ব্যবহার করা হয়।
    • ব্রঙ্কোডাইলেটর (Bronchodilator): শ্বাসকষ্ট হলে শ্বাস নালী প্রসারিত করতে সাহায্য করে। ইনহেলারের মাধ্যমে এটি সাধারণত ব্যবহার করা হয়।
    • এপিনেফ্রিন ইনজেকশন (Epinephrine Injection): মারাত্মক অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়ার (অ্যানাফিল্যাক্সিস) চিকিৎসার জন্য এটি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। যাদের মারাত্মক অ্যালার্জির ঝুঁকি রয়েছে, তাদের সবসময় এটি সাথে রাখা উচিত এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নেওয়া উচিত।
  • অ্যালার্জি ইমিউনোথেরাপি (Allergy Immunotherapy): কিছু নির্দিষ্ট অ্যালার্জির ক্ষেত্রে, যেমন পরাগ রেণু বা পোকামাকড়ের কামড়, ইমিউনোথেরাপি একটি দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা পদ্ধতি হতে পারে। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে শরীরের অ্যালার্জেনের প্রতি সহনশীলতা বৃদ্ধি করা হয়।

বাবা-মায়ের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ:

  • শিশুকে অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী খাবার বা পরিবেশগত উপাদান থেকে দূরে রাখুন।
  • শিশুর ঘরে ধুলোবালি জমতে দেবেন না এবং নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন।
  • পোষা প্রাণী থাকলে তাদের নিয়মিত পরিষ্করণ করুন এবং শিশুর শোবার ঘরে তাদের প্রবেশাধিকার সীমিত করুন।
  • ধূমপান শিশুর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, তাই বাড়িতে ধূমপান করা থেকে বিরত থাকুন।
  • নতুন কোনো খাবার শিশুর খাদ্য তালিকায় যোগ করার সময় প্রথমে অল্প পরিমাণে দিন এবং দেখুন কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কিনা।
  • শিশুকে অ্যালার্জির লক্ষণ ও মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার লক্ষণ সম্পর্কে শেখান, যাতে সে প্রয়োজনে সাহায্য চাইতে পারে।
  • স্কুল বা ডে-কেয়ার সেন্টার কর্তৃপক্ষকে শিশুর অ্যালার্জি সম্পর্কে অবগত রাখুন এবং প্রয়োজনে এপিনেফ্রিন ইনজেকশনের ব্যবস্থা রাখুন।
  • নিয়মিত শিশু রোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ রাখুন এবং তার পরামর্শ অনুযায়ী চলুন।

বাচ্চাদের অ্যালার্জি একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, এর সঠিক ব্যবস্থাপনা শিশুর সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতা এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে শিশুদের অ্যালার্জির কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। তাই অ্যালার্জির লক্ষণ দেখা গেলে দেরি না করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং আপনার সন্তানের প্রতি বিশেষ যত্ন নিন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন