গর্ভাবস্থায় সাধারণ সমস্যা ও তার সমাধান

 


গর্ভাবস্থা একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া হলেও এই সময় অনেক নারী কিছু সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। সঠিক জ্ঞান এবং কিছু ঘরোয়া প্রতিকারের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করা সম্ভব। নিচে গর্ভাবস্থায় সাধারণত দেখা দেওয়া কিছু সমস্যা এবং তাদের সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করা হলো:

১. সকালের দুর্বলতা (Morning Sickness): গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়া একটি সাধারণ সমস্যা।

  • সমাধান: অল্প অল্প করে বার বার খাবার খান। শুকনো খাবার যেমন বিস্কুট বা টোস্ট সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরপরই খেতে পারেন। তৈলাক্ত ও মশলাদার খাবার পরিহার করুন। আদা চা বা লেবুর গন্ধ উপশম দিতে পারে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন।

২. বুক জ্বালাপোড়া (Heartburn): হরমোনের পরিবর্তন এবং জরায়ুর আকার বৃদ্ধির কারণে পাকস্থলীর অ্যাসিড খাদ্যনালীতে উঠে এলে বুক জ্বালাপোড়া অনুভূত হতে পারে।

  • সমাধান: ছোট ছোট ভাগে খাবার খান এবং খাওয়ার পর কিছুক্ষণ সোজা হয়ে বসুন বা হাঁটুন, সাথে সাথে শুয়ে পড়বেন না। মশলাদার ও তৈলাক্ত খাবার, ক্যাফেইন এবং কার্বনেটেড পানীয় এড়িয়ে চলুন। রাতে ঘুমানোর আগে ভারী খাবার খাবেন না। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টাসিড ব্যবহার করা যেতে পারে।

৩. কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation): হরমোনের প্রভাবে হজম প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যাওয়া এবং জরায়ুর চাপের কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে।

  • সমাধান: প্রচুর পরিমাণে জল পান করুন। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার যেমন ফল, সবজি এবং শস্য খাদ্যতালিকায় যোগ করুন। হালকা ব্যায়াম করুন। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হালকা ল্যাক্সেটিভ ব্যবহার করা যেতে পারে।

৪. পিঠে ব্যথা (Back Pain): গর্ভাবস্থায় শরীরের ওজন বৃদ্ধি এবং হরমোনের পরিবর্তনের কারণে পিঠে ব্যথা হতে পারে।

  • সমাধান: সঠিক ভঙ্গিতে বসুন ও দাঁড়ান। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকলে বিরতি নিন। হালকা ব্যায়াম ও স্ট্রেচিং করুন। গরম বা ঠান্ডা সেঁক দিতে পারেন। রাতে ঘুমানোর সময় কোলের নিচে বালিশ ব্যবহার করুন। ভারী জিনিস তোলা থেকে বিরত থাকুন।

৫. পায়ে ও গোড়ালিতে ফোলা (Swelling in Legs and Ankles): গর্ভাবস্থায় শরীরে জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় পায়ে ও গোড়ালিতে হালকা ফোলাভাব দেখা দিতে পারে।

  • সমাধান: দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা বা বসে থাকা পরিহার করুন। বসে থাকার সময় পায়ের নিচে একটি ছোট টুল ব্যবহার করুন। রাতে ঘুমানোর সময় পায়ের নিচে বালিশ রাখুন। পর্যাপ্ত জল পান করুন। লবণাক্ত খাবার কম খান। যদি অতিরিক্ত ফোলা বা হঠাৎ করে ফোলা দেখা দেয়, তবে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।

৬. ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ (Frequent Urination): গর্ভাবস্থায় জরায়ুর চাপের কারণে মূত্রাশয়ের উপর চাপ পড়ে এবং ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ অনুভূত হতে পারে।

  • সমাধান: পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করুন, তবে রাতে ঘুমানোর আগে জল কম পান করতে পারেন। ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় পরিহার করুন। প্রস্রাবের বেগ পেলে আটকে রাখবেন না।

৭. ক্লান্তি ও দুর্বলতা (Fatigue and Weakness): গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তন এবং শরীরের অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণে ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভূত হতে পারে।

  • সমাধান: পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিন। দিনের বেলায় ছোট ছোট বিরতি নিন। সুষম ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন। হালকা ব্যায়াম শরীরকে সচল রাখতে সাহায্য করে।

৮. মাথা ঘোরা (Dizziness): গর্ভাবস্থায় রক্তচাপের পরিবর্তনের কারণে মাথা ঘোরা অনুভূত হতে পারে।

  • সমাধান: ধীরে ধীরে বসুন বা দাঁড়ান। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা পরিহার করুন। পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করুন। নিয়মিত খাবার খান। মাথা ঘুরলে কোথাও বসে বিশ্রাম নিন।

৯. স্তনে পরিবর্তন (Changes in Breasts): গর্ভাবস্থায় হরমোনের প্রভাবে স্তন ভারী ও স্পর্শকাতর হতে পারে।

  • সমাধান: আরামদায়ক এবং সঠিক মাপের ব্রা ব্যবহার করুন। প্রয়োজনে সাপোর্ট ব্রা ব্যবহার করতে পারেন।

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত:

যদিও গর্ভাবস্থায় ছোটখাটো সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক, তবে কিছু লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি:

  • প্রচণ্ড পেটে ব্যথা
  • যোনিপথে রক্তপাত
  • অতিরিক্ত বমি বা বমি বন্ধ না হওয়া
  • জ্বর
  • তীব্র মাথাব্যথা
  • দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া
  • পেটের বাচ্চার নড়াচড়া কমে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়া
  • শরীরে অতিরিক্ত ফোলা বা হঠাৎ করে ওজন বৃদ্ধি

গর্ভাবস্থায় নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল রাখা এবং যেকোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া মা ও শিশুর উভয়ের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক যত্ন ও সচেতনতার মাধ্যমে গর্ভাবস্থার অনেক সাধারণ সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব এবং একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক গর্ভাবস্থা উপভোগ করা যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন