প্রসব পরবর্তী মায়ের যত্ন ও নবজাতকের পরিচর্যা

 





প্রসবের পর মায়ের শরীর এবং মনে অনেক পরিবর্তন আসে। এই সময় মায়ের সঠিক যত্ন নেওয়া এবং নবজাতকের সঠিক পরিচর্যা করা উভয়ের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রসব পরবর্তী সময়কাল (Postpartum period) প্রায় ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হয় এবং এই সময়ে মাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হতে সাহায্য করা প্রয়োজন।

প্রসব পরবর্তী মায়ের যত্ন:

প্রসবের পর মায়ের শরীর ধীরে ধীরে গর্ভাবস্থার পরিবর্তনগুলো থেকে সেরে উঠতে শুরু করে। এই সময় কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি:

  • শারীরিক বিশ্রাম: প্রসবের পর মায়ের শরীর দুর্বল থাকে। তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া অপরিহার্য। যখন শিশু ঘুমায়, তখন মায়েরও বিশ্রাম নেওয়া উচিত। অতিরিক্ত পরিশ্রম এড়িয়ে চলতে হবে।
  • সুষম আহার: প্রসবের পর মায়ের শরীরে শক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা জরুরি। প্রোটিন, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম এবং আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাদ্যতালিকায় যোগ করুন। পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করুন।
  • যোনিপথের যত্ন: স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে যোনিপথে ক্ষত থাকতে পারে। এলাকাটি পরিষ্কার ও শুকনো রাখতে হবে। ডাক্তার যদি কোনো ওষুধ বা মলম দিয়ে থাকেন, তা নিয়মিত ব্যবহার করুন।
  • স্তনের যত্ন: শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। স্তনের স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখুন। স্তনে ব্যথা বা ফোলাভাব হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
  • মানসিক স্বাস্থ্য: প্রসব পরবর্তী সময়ে অনেক নারী মানসিক দুর্বলতা বা বিষণ্ণতা অনুভব করতে পারেন (Postpartum Depression)। যদি মন খারাপ থাকে, অতিরিক্ত কান্না পায়, বা শিশুর প্রতি আগ্রহ কমে যায়, তবে দ্রুত পরিবারের সদস্য বা ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারের সাহায্য নেওয়া এক্ষেত্রে খুবই জরুরি।
  • নিয়মিত চেকআপ: প্রসবের কয়েক সপ্তাহ পর ডাক্তারের কাছে গিয়ে নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত। কোনো জটিলতা থাকলে তা শনাক্ত করা এবং চিকিৎসা করা সম্ভব হবে।
  • হালকা ব্যায়াম: ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ধীরে ধীরে হালকা ব্যায়াম শুরু করতে পারেন। এটি শরীরের রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে এবং দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করবে।

নবজাতকের পরিচর্যা:

নবজাতকের প্রথম কয়েক সপ্তাহ তার জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক পরিচর্যা তার সুস্থ বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়ক।

  • বুকের দুধ: জন্মের পর প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত। বুকের দুধে শিশুর প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি উপাদান এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি কারী অ্যান্টিবডি থাকে। চাহিদা অনুযায়ী শিশুকে বার বার দুধ খাওয়ান।
  • পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা: নবজাতককে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি। প্রতিদিন হালকা গরম জলে স্নান করান। নবজাতকের ত্বক খুব সংবেদনশীল তাই সাবান ও অন্যান্য প্রসাধনী ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করুন।
  • পোশাক: নবজাতককে আরামদায়ক ও হালকা পোশাক পরান। ঋতু অনুযায়ী পোশাকের পরিবর্তন করুন। অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা থেকে শিশুকে রক্ষা করুন।
  • ঘুম: নবজাতক দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে থাকে। তাকে চিৎ করে শোয়ান এবং ঘুমের পরিবেশ শান্ত রাখুন।
  • নাভির যত্ন: নাভি শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত শুকনো ও পরিষ্কার রাখুন। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নাভির যত্ন নিন।
  • টিকাকরণ: শিশুর জন্মের পর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক সময়ে টিকাকরণ করানো অপরিহার্য। এটি শিশুকে বিভিন্ন মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা করে।
  • সাধারণ অসুস্থতা: নবজাতকের সর্দি, কাশি বা হালকা জ্বর হতে পারে। এই সময় ঘরোয়া পরিচর্যার পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যান।
  • নিরাপত্তা: নবজাতককে সব সময় সাবধানে ধরুন। ঝাঁকুনি দেওয়া বা জোরে খেলাধুলা করা থেকে বিরত থাকুন। ছোটখাটো জিনিস থেকে দূরে রাখুন যা সে গিলে ফেলতে পারে।

পরিবারের ভূমিকা:

প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়ের এবং নবজাতকের যত্নে পরিবারের সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মায়ের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা, তাকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে সাহায্য করা এবং নবজাতকের পরিচর্যায় সহায়তা করা অপরিহার্য। মায়ের একাকীত্ব দূর করতে এবং তাকে মানসিক সাহস যোগাতে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা খুব জরুরি।

প্রসব পরবর্তী সময়কাল মা ও শিশুর জন্য একটি নতুন যাত্রা শুরু হওয়ার সময়। সঠিক যত্ন, ভালোবাসা এবং সহযোগিতা উভয়ের সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে। এই সময় ধৈর্য ধরুন এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন। প্রয়োজনে স্বাস্থ্যকর্মী বা ডাক্তারের পরামর্শ নিতে দ্বিধা করবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন